প্রতিবছর মকর সংক্রান্তির সময়, অনুষ্ঠিত হয গঙ্গাসাগর মেলা যা আসলে ভারতবর্ষের গৌরবমণ্ডিত প্রাচীন সংস্কৃতির উদযাপন। সূর্য দেব (সূর্য দেবতা) ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে স্থানান্তরিত হওয়ার পুণ্য সময়ে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী সাগরসঙ্গমের পবিত্র জলে ডুব দিতে গঙ্গাসাগরে আসেন। বলা হয়, সঠিক মুহূর্তে গঙ্গাসাগরে স্নান করলে সমস্ত অর্জিত পাপ ধ্বংস হয় এবং মোক্ষ অর্জিত হয়, একেই শাহি স্নান বলে। শাহি স্নানের পরেও, বেশকিছু আচার-অনুষ্ঠান পরবর্তী ৩ দিন ধরে পালিত হয়।
এমনই একটি ধর্মীয আচার হল, পঞ্চরত্ন ও সূতা প্রদান। এই প্রথা অনুযায়ী, পঞ্চরত্ন ও পবিত্র সূতা নদীর খাতে ভাসানো হয়, যা নদীর স্রোতে সমুদ্রে গিয়ে মেশে। এই সম্পূর্ন প্রথাটি ত্যাগের প্রতীক।
মকর সংক্রান্তির দিন ভোরবেলায় ভক্তরা নির্বাণ প্রাপ্তির আশায় সাগরের ঠাণ্ডা জলে ডুব দেয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের মাথা ন্যাড়া করে আবার কেউ কেউ তাদের প্রয়াত পিতা-মাতার জন্য শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করে। তারপর দুপুর অবধি চলে স্নানের আচার। স্নান হয়ে গেলে তারা পূজাপাঠের উদ্দেশ্যে কপিল মুনির মন্দিরে যায় এবং তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সন্ধ্যাবেলা সমুদ্রের জল ভক্তদের ভাসানো হাজার হাজার প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়, যা সেই মুহূর্তকে অসীম এক উচ্চতায় উন্নীত করে।
বৈতরণী পার
গরুড় পুরাণের ৪৭তম অধ্যায়ে বৈতরণী নদীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই নদী জীবজগৎ ও মরজগতের মধ্যবর্তী সম্পর্কস্বরূপ। পুরাণে বলা হয়েছে, মৃতের আত্মারা এই নদী পার করে তবেই স্বর্গে পৌঁছন আর যারা কারও প্রতি কখনও সদয় হয়নি বা অন্যদের সাহায্য করেননি তাদের আত্মা এই নদী পেরোতে পারে না এবং নরকের অতল গহ্বরে পতিত হয়। কিন্তু সেইসব অসহায় আত্মা গরুর লেজ ধরে এই নদী পার হতে পারে। সেইকারণে মকর সংক্রান্তির দিন, অসংখ্য মানুষ সাগর পাড়ে ভিড় করেন গরুর লেজ ধরে ‘বৈতরণী পার’ আচার পালন করবার জন্য।
কপিল মুনি মন্দিরে পূজা
প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর গঙ্গাসাগরে আসার একটি অন্যতম কারণ হল কপিল মুনির মন্দিরে পূজা অর্পণ করা। এই সমস্ত পুণ্যার্থীরা সাগরসঙ্গমের পুণ্যজলে স্নান করে পূজা দিতে কপিল মুনির মন্দিরে যায়। মন্দিরে পূজা দিয়ে মহর্ষি কপিলের আশীর্বাদ পেয়ে তারা শান্তিলাভ করে। সন্ধ্যায় সাগরপাড়ে পণ্ডিতদের মন্ত্রপাঠের মধ্যে সমুদ্রের জলে অসংখ্য ভাসমান প্রদীপের আলোয় গঙ্গাসাগর এক অনন্য রূপ গ্রহণ করে।
পুণ্যস্নান
জন্ম ও মৃত্যুর যে অনন্তচক্র তার থেকে মুক্তিই মোক্ষ। বলা হয়, মকরসংক্রান্তির মহালগ্নে সাগরসঙ্গমের পবিত্র জলে স্নান করলে মানুষের মোক্ষ প্রাপ্তি হয়। সেই কারণে মকর সংক্রান্তির দিন সারা বিশ্ব থেকে আগত লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী গঙ্গাসাগরের পবিত্র জলে স্নান করেন। যুগ যুগ ধরে মানুষ মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য এই বিশ্বাসে ভর করে অপেক্ষা করেছে গঙ্গাসাগরের পুণ্যভূমিতে মকর সংক্রান্তি উদযাপনের। এইভাবেই গঙ্গাসাগর ভক্তি ও বিশ্বাসের এক চিরকালীন ঐতিহ্য হয়ে থেকে গেছে ভক্তদের মনে।